তাকওয়া বা আল্লাহভীতি: সফলতার মূল চাবিকাঠি
তাকওয়া অর্জনের পথ
একা নয়, একসাথে
তাকওয়া কী?
তাকওয়া হলো সকল বিষয়ের মূল। এর ভিত্তি হলো আল্লাহ্ ভয়। আল্লাহ্ কুরআনে অসংখ্যবার তাঁর ভয় অন্তরে রাখার আদেশ দিয়েছেন।
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; এবং প্ৰত্যেকের উচিত চিন্তা করে দেখা আগামী কালের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে।
আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; তোমরা যা কর নিশ্চয় আল্লাহ সে সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত।
(আল হাশর ১৮)
তাকওয়ার প্রথম পুরস্কার: সকল সংকট থেকে মুক্তির পথ
আল্লাহ বলেন,
وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَهُ مِنْ أَمْرِهِ يُسْرًا
‘যে লোক আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার কাজ সহজ ও সুবিধাজনক করে দেন’ (তালাক ৪)।
যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য সংকট থেকে বের হয়ে আসার রাস্তা তৈরি করে দেন,যখন পরীক্ষার হলে খেয়ানত করার সুযোগ আসে, যখন হারাম উপার্জনের হাতছানি দেয়, তাকওয়া অবলম্বনকারীকে আল্লাহ্ সেই সংকট থেকে উত্তরণের পথ দেখিয়ে দেন।
তাকওয়ার দ্বিতীয় পুরস্কার: অচিন্তনীয় উৎস থেকে রিজিক
পৃথিবীর প্রত্যেক জীবের জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহর। তিনি জানেন তারা কোথায় থাকে এবং কোথায় সমাপিত হয়। (সূরা হুদ, আয়াত, ৬)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ
"এবং তাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দান করেন, যা সে কল্পনাও করতে পারেনি।" (তালাক ৩)
যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে হারাম চাকরি বা সুযোগ ছেড়ে দেয়, এই ভেবে ভরসা রাখে যে আল্লাহই যথেষ্ট, আল্লাহ্ তার জন্য এমন উৎস থেকে হালাল রিজিকের ব্যবস্থা করেন যা তার কল্পনার বাইরে ছিল।
তাকওয়ার তৃতীয় পুরস্কার: সকল কাজে সহজতা
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجً
"যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য মুক্তির পথ তৈরি করে দেন ।"(তালাক ২)
দুনিয়া ও আখেরাতের সকল বৈধ ও কল্যাণকর কাজে আল্লাহ্ তার জন্য সহজতা নিয়ে আসেন।
কঠিন পরিস্থিতিগুলো তার জন্য সরল হয়ে যায়।
তাকওয়ার এক বাস্তব প্রতিদান
এক দরিদ্র কিন্তু মুত্তাকী ব্যক্তি বাজারে একটি স্বর্ণের ব্যাগ খুঁজে পান।লোভনীয় হওয়া সত্ত্বেও তিনি আল্লাহ্ ভয়ে মালিককে খুঁজে বের করে ব্যাগটি ফিরিয়ে দেন।কিছুকাল পর, সেই স্বর্ণের মালিকের মেয়ের সাথেই তার বিয়ে হয় এবং তিনি সেই সকল স্বর্ণের বৈধ মালিক হয়ে যান।আল্লাহ্ দেখালেন, তাঁর জন্য হারাম ছেড়ে দিলে তিনি কিভাবে উত্তম প্রতিদান দেন।সে তার কল্পনার জায়গাটাকে আল্লাহর জন্য ছেড়ে দিয়েছিল, আর আল্লাহ্ তাকে এমনভাবে প্রতিদান দিলেন যা সে কখনো কল্পনাও করেনি।
এই পুরস্কারগুলো তো জানলাম।
কিন্তু এই তাকওয়া অর্জন হবে কিভাবে?
কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা: একা চলা অসম্ভব
يا ايها الذين امنوا اتقوا الله وكونوا مع الصادقين
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো।”
(সূরা আত-তাওবা,১১৯)
যে মুত্তাকী হতে চায়, তার জন্য এটা বাধ্যতামূলক যে সে মুত্তাকীদের সাথে থাকবে। একাকী তাকওয়া অর্জনের চেষ্টা করা প্রায় অসম্ভব।
কারণ মানুষের ঈমান ও আমল পরিবেশ ও সঙ্গের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়।
আলেম ও নেককার মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে সঠিক জ্ঞান পাওয়া যায়, ভুল থেকে বাঁচা সহজ হয় এবং তাকওয়ার পথে অবিচল থাকা সম্ভব হয়।
আর খারাপ সঙ্গ মানুষকে অজান্তেই গুনাহ ও গাফিলতির দিকে টেনে নেয়।
একাকী তাকওয়া ধরে রাখা কঠিন, কারণ মানুষ সঙ্গ দ্বারা প্রভাবিত হয়।
আলেম ও নেককারদের সাথে সম্পর্ক ঈমানকে শক্ত করে এবং সঠিক পথে অবিচল রাখে।
বিচ্ছিন্নতার বিপদ: তাবুকের যুদ্ধের শিক্ষা
তাবুকের যুদ্ধ ছিল প্রত্যেক সক্ষম মুমিনের জন্য ফরজ। কিন্তু তিনজন মুখলিস সাহাবী কাব ইবনু মালিক (রা.) , হিলাল ইবনু উমাইয়া (রা.) , মুরারা ইবনু রাবি (রা.) জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার কারণে পিছনে রয়ে যান।
তারা ভেবেছিলেন, "ওরা এগিয়ে যাক, আমার তো দ্রুতগামী বাহন আছে, আমি পরে তাদের সাথে যোগ দেবো।"এই "আজ যাই, কাল যাই" করতে করতে আর যেতেই পারেননি।আল্লাহর বিধান না আসা পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং সমস্ত মদিনাবাসী তাদের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন।তারা সালাম দিতেন, কিন্তু কেউ তাদের সালামের উত্তর দিতো না।এমনকি তাদের নিজেদের স্ত্রীদের থেকেও আলাদা থাকতে বলা হয়।
'ঈমানের সর্বোচ্চ স্তরে থেকেও শুধু জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে তাদের এইকঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।'
নেকড়ে শুধু সেই ছাগলকেই আক্রমণ করে, যা পাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একা থাকে।
শয়তানও ঠিক সেই ঈমানদারের উপরই আধিপত্য বিস্তার করে, যে নিজেকে মুমিনদের সংঘ ও সাহচার্য থেকে দূরে রাখে।একাকী অবস্থায় গুনাহে জড়িয়ে পড়া অনেক সহজ।
আমরা কাদের অনুসরণ করব?
আল্লাহ্ বলেছেন 'সত্যবাদীদের' (সাদিকীন) সাথে থাকতে। কিন্তু এই সত্যের মাপকাঠি কারা? বর্তমানের কোনো দল, সংগঠন বা ব্যক্তি?
কোনো ব্যক্তি বা দল ভুলের উর্ধ্বে নয়। আমাদের এমন এক প্রজন্মকে অনুসরণ করতে হবে, যাদের সফলতার গ্যারান্টি স্বয়ং আল্লাহ্ দিয়েছেন।
সত্যের একমাত্র মাপকাঠি: সাহাবায়ে কেরাম
কেন তাদের?
আল্লাহর প্রশংসা: আল্লাহ্ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং
رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ
হেদায়েতের শর্ত: আল্লাহ্ বলেছেন তাদের মতো ঈমান আনলেই হেদায়েত পাওয়া যাবে
فَإِنْ آمَنُوا بِمِثْلِ مَا آمَنْتُمْ بِهِ فَقَدِ اهْتَدَوْا
উম্মতের শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম: রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের যুগকে সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ বলেছেন।
এই উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে সফল হলেন সাহাবায়ে কেরাম। তাই অনুসরণ করতে হবে সফলদেরই।
সাহাবায়ে কেরামের উপলব্ধি ও আমল
কুরআন ও সুন্নাহ বোঝার সঠিক পদ্ধতি
কুরআন ও হাদিস তখনই সঠিকভাবে বোঝা সম্ভব, যখন তা সাহাবায়ে কেরামের উপলব্ধি ও আমলের আলোকে দেখা হয়।
উদাহরণ: উসমান (রাঃ) কর্তৃক প্রবর্তিত জুমু'আর দ্বিতীয় আযান। এটি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর যুগে ছিল না, কিন্তু খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত হওয়ার কারণে তা পালনীয়।
যারা এর সমালোচনা করে, তারা রাসুলের "আমার এবং আমার খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে আঁকড়ে ধরো" এই নির্দেশ অমান্য করে।
সাহাবাদের বাদ দিয়ে দ্বীন বোঝা মানে গোমরাহির পথে পা বাড়ানো।
"তাকওয়া = আল্লাহ্ ভয় + সাহাবাদের সাহচর্য"